মাংস খাওয়া নিয়ে ৮টি অদ্ভূত ভুল ধারণা


পুষ্টি উপাদান নিয়ে মানুষের চিন্তা সব সময়ের। হাজারো খাবারের মধ্যে মাংস নিয়ে মানুষের ভুল চিন্তা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দেহের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় আমিষের এ উৎস নিয়ে সবার ভুল চিন্তা দূর করতে চান বিশেষজ্ঞরা। এখানে মাংস নিয়ে আটটি অদ্ভুত ভুল ধারণা তুলে ধরা হলো যা মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে সত্য মনে করে আসছে।

১. মাংস হজম হয় কোলন বা মলাশয়ে

অনেকে দাবি করেন, মাংসের পরিপাক হয় দেহের মলাশয়ে। মানুষকে এ খাবারটি থেকে দূরে রাখতে মূলত এই ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন পুষ্টি বিজ্ঞানীরা।

মাংস খাওয়ার পর আসলে কী ঘটে? গলধঃকরণের পর মাংস পাকস্থলীতে গিয়ে এসিড ও পরিপাক এনজাইম দ্বারা ভেঙে যায়। এর প্রোটিন ভেঙে এমাইনো এসিড এবং চর্বি ভেঙে ফ্যাটি এসিডে পরিণত হয়। এরপর তা হজমী দেয়াল গ্রহণ করে রক্তে ছড়িয়ে দেয়। কাজেই মলাশয়ে গিয়ে হজম হওয়ার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

আসলে মলাশয়ে গিয়ে পরিপাক হওয়ার কিছু থাকলে তা আঁশযুক্ত শাক-সবজি, ফল বা শস্য থেকে আসে। কারণ এসব আঁশ হজমের কোনো এনজাইম মানুষের দেহে নেই। তাই এগুলো মলাশয়ে গিয়ে সেখানকার পাচক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভেঙে পুষ্টি ও উপকারী উপাদানে পরিণত হয়।

২. মাংসের চর্বি ও কোলেস্টরেল বিপদজনক

এ দুই উপাদানের জন্য অনেকের কাছেই মাংস ভীতিকর। আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ আধুনিক বিজ্ঞান দেখেছে, চর্বি ও কোলেস্টরেল আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়।

কোলেস্টরেল নিয়ে ভয়ের যা ছিলো তা ভুলে যান। আসলে এটা অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য অণু যা দেহের প্রতিটি মেমব্রেনে পাওয়া যায় এবং যা হরমোন তৈরিতে সহায়তা করে। লিভার প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টরেল উৎপাদন করে। তবে খাদ্যদ্রব্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণে এ উপাদান পাওয়া গেলে লিভার কম উৎপাদন করে।

 শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের রক্তের কোলেস্টরেলের ওপর খাদ্যের কোলেস্টরেলের কোনো প্রভাব নেই। বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের রক্তে এলডিএল কোলেস্টরেল (লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) সামান্য বেড়ে যায়। এলডিএল কোলেস্টরেল দেহের জন্য ক্ষতিকর। আবার এইচডিএল কোলেস্টরেল (হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) বাড়ে যা দেহের জন্য ভালো। উন্নত মানের ফ্যাট এইচডিএল কোলেস্টরেলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

এমনকি সম্পৃক্ত ফ্যাট ও কোলেস্টরেল সামান্য এলডিএল বাড়ালেও তা ভেঙে ক্রমেই লার্জ এলডিএল-এ পরিণত হয় যা দেহের জন্য উপকারী। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। কাজেই সম্পৃক্ত ফ্যাট ও কোলেস্টরেল শেষ পর্যন্ত হৃদরোগের জন্য দায়ী নয় এবং তা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।

৩. হৃদরোগ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় মাংস

বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিক থেকে হৃদরোগ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সমস্যা শুরু হয় কয়েক যুগ আগ থেকে। লক্ষ বছর ধরে মানুষ মাংস খেয়ে আসছে, কিন্তু হৃদযন্ত্র বা ডায়াবেটিসের সমস্যা হয়নি। কাজেই এ দুয়ের জন্য মাংসকে দায়ী করা ঠিক নয়।

২০১০ সালে এ বিষয়ে এক বিশাল গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। বিভিন্ন ২০টি গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ১২ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, মাংস গ্রহণের সঙ্গে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্কই নেই।

ইউরোপের আরেকটি বড় গবেষণায় ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬৮ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে একই ফল পাওয়া গেছে।

৪. লাল মাংস ক্যান্সারের কারণ

এটা ঠিক যে, প্রসেস করা মাংসে ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু সরাসরি মাংস খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই।

এর আগে বেশ কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, অপ্রক্রিয়াজাত লাল মাংস ক্যান্সারের কারণ। পরে আরো গভীর গবেষণায় দেখা গেছে, মাংস অতিমাত্রায় রান্না করা হলে হেটারোসাইক্লিক অ্যামাইনস এবং পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনস তৈরি হয়। এ উপাদানগুলো অন্যান্য পশুদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করেছে।

৫. মানুষ প্রজাতি প্রাকৃতিকভাবে নিরামিষভোজী, আমিষভোজী নয়

অনেকেই বলেন, মানুষ প্রাণী হিসেবে নিরামিষভোজী হয়ে জন্ম নিয়েছে। এটা পুরোই মিথ্যে। কারণ আদিম যুগ থেকে মানুস মাংস খেয়ে আসছে এবং মানুষের পাকস্থলী মাংস গ্রহণের জন্য দারুণ উপযুক্ত। প্রাণীজ খাদ্যের প্রোটিনকে ভেঙে পরিপাক করার জন্য প্রচুর হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপাদন করে পাকস্থলী। এ ছাড়া পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাণীর মাংস থেকে প্রাপ্ত আমিষ বরং মস্তিষ্কের উন্নতিসাধনে ভূমিকা রাখে।

এভাবে নিরামিষ এবং আমীষ উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণের জন্য উপযুক্ত প্রত্যঙ্গ রয়েছে মানুষের দেহে। কাজেই মানুষ আসলে সর্বভোজী।     

৬. মাংস হাড়ের জন্য ক্ষতিকর

অনেকের দাবি, প্রোটিন হাড়ের অস্টেওপরোসিসের জন্য দায়ী থাকে যা হাড়ের খনিজ উপাদানসমূহ হ্রাস করে নানা সমস্যা তৈরি করে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

দেখা গেছে, প্রোটিন এসিড বৃদ্ধি করে দেহে। পরে দেহ হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নিয়ে রক্তে পাঠিয়ে দেয় এসব এসিডকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। তবে অল্প সময়ের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোটিন হাড়ের ক্ষয় করে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের গবেষণায় দেখা যায়, তা বরং হাড়ের উপকার করে।

উন্নত প্রোটিন হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে অস্টেওপরোসিসের ঝুঁকি কমায় এবং বৃদ্ধ বয়েসে হাড় ক্ষয়ের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

৭. মাংস না খেলেও চলে

কতো খাবার আছে, তাই মাংস না খেলেও চলে বলেই মত দেন অনেকে। আসলে এক অর্থে এটি সত্য তথ্য। বেঁচে থাকার জন্য দেহের যা প্রয়োজন তা অন্যান্য খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। আবার মাংস ছাড়া আমরা সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে পারবো না। কারণ দেহের জন্য প্রয়োজনীয় আদর্শ মানের প্রোটিন, ভিটামিন বি১২, ক্রিয়েটিন, ক্যারনোসিন এবং নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাট-সংশ্লিষ্ট ভিটামিন ইত্যাদি অন্য কোনো উৎস থেকে সঠিক মাত্রায় পাওয়া যায় না।

৮. মাংসে ওজন বাড়ে

মাংস খেলেই বোধহয় মোটা হয়ে যাবো- এ ভয়টা স্বাস্থ্য সচেতনদের মধ্যে জোরালোভাবে মাথাচাড়া দেয়। কারণ মাংসে ফ্যাট এবং ক্যালোরি রয়েছে। যাহোক, মাংসে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রোটিন রয়েছে যা পরবর্তীতে সবচেয়ে হালকা সূক্ষ্ম পুষ্টি উপাদানে পরিণত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোটিন দেহের শক্তি-সজীবতা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ ক্যালোরি শক্তি সৃষ্টি করে।

গবেষণায় ওজন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ভিন্ন ফলাফল দেখা গেছে। মানুষ যখন বেশি পরিমাণ প্রোটিন প্রাণী থেকে গ্রহণ করে, তখন তার বেঁচে থাকার জন্য অন্য উৎস থেকে আর খাবার গ্রহণ করে না। তা ছাড়া এই প্রাণীজ প্রোটিন দীর্ঘক্ষণের জন্য ক্ষুধা নিবারণ করে। ফলে মানুষ কম পরিমাণে অন্য খাবার গ্রহণ করে এবং এতে বরং দেহের ওজনে ভারসাম্য আসে।

0 Comment "মাংস খাওয়া নিয়ে ৮টি অদ্ভূত ভুল ধারণা"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your comments